মানুষের জীবনে রিজিক একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। অনেকেই লক্ষ্য করেন, পরিশ্রম করার পরও রিজিকের বরকত কমে যাচ্ছে। টাকা আসে, আবার দ্রুত শেষও হয়ে যায়। প্রশ্ন জাগে – কেন এমন হচ্ছে? আসলে, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে রিজিক শুধু অর্থ বা ধনসম্পদ নয়; বরং স্বাস্থ্য, জ্ঞান, শান্তি, সম্পর্ক—সবই রিজিকের অন্তর্ভুক্ত। আজ আমরা আলোচনা করব আপনার রিজিক কেন কমে যাচ্ছে? ৫টি গোপন কারণ নিয়ে, সাথে থাকছে করণীয় উপায়।
রিজিকের ধারণা: ইসলামী ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
রিজিক শব্দটি মূলত আরবি ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে জীবিকা, উপার্জন বা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত দান। ইসলামে রিজিককে কেবল অর্থ বা সম্পদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। বরং রিজিক বলতে স্বাস্থ্য, জ্ঞান, সন্তান, ভালো সম্পর্ক, শান্তি, সুখ—এসবকেও বোঝানো হয়।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ
আল্লাহর কিতাব কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—
“পৃথিবীতে যে কোনো প্রাণী আছে, তাদের রিজিক আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল।” (সূরা হুদ: ৬)
অর্থাৎ, প্রতিটি জীবের জন্য আল্লাহ নির্দিষ্ট পরিমাণ রিজিক নির্ধারণ করে রেখেছেন। তবে মানুষকে সেই রিজিক অর্জনের জন্য হালাল পথে চেষ্টা করতে হয়।
সামাজিক দৃষ্টিকোণ
আজকের সমাজে রিজিককে সাধারণত অর্থ, চাকরি, ব্যবসা বা সম্পদের সাথে মিলিয়ে দেখা হয়। তবে অনেকে ভুলে যান, রিজিক মানেই শুধু টাকার অঙ্ক নয়। অনেক টাকা উপার্জন করেও যদি কারো পরিবারে শান্তি না থাকে, সুস্থতা না থাকে, তবে তা পূর্ণ রিজিক হিসেবে গণ্য হয় না।
📌 তাই রিজিকের প্রকৃত অর্থ হলো— আল্লাহর প্রদত্ত সকল নেয়ামত যা আমাদের জীবনকে চলমান রাখে এবং তাতে বরকত এনে দেয়।
রিজিক কেন কমে যায় – বাস্তবতার আলোকে
মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে এমন সময় আসে, যখন দেখা যায়— আয় যথেষ্ট হলেও তা টিকছে না। ঋণ বাড়ছে, সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে, অথবা শান্তি হারিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ কী? আসুন জেনে নেই ৫টি গোপন কারণ।
গোপন কারণ ১: অকৃতজ্ঞতা ও আল্লাহর স্মরণ ভুলে যাওয়া
-
মানুষ যখন আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে না, তখন রিজিক থেকে বরকত সরে যায়।
-
আমরা সাধারণত যে নেয়ামত প্রতিদিন ভোগ করছি— যেমন পানি, বাতাস, স্বাস্থ্য, পরিবার—এসবের জন্য কৃতজ্ঞ থাকি না।
👉 কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তোমরা কৃতজ্ঞ হলে আমি অবশ্যই তোমাদের আরও বেশি দেব।” (সূরা ইবরাহিম: ৭)
তাহলে স্পষ্ট হলো—শোকর আদায় করলে রিজিক বাড়ে, আর অকৃতজ্ঞ হলে রিজিক কমে যায়।
গোপন কারণ ২: হারাম আয়ের উপর নির্ভরশীলতা
-
সুদ, ঘুষ, প্রতারণা, জুয়া, মাদক—এসব থেকে পাওয়া অর্থ কখনোই বরকতময় হতে পারে না।
-
হারাম উপার্জনের ফলে জীবনে শান্তি থাকে না, পারিবারিক অশান্তি বাড়ে।
-
হাদীসে এসেছে: “যে দেহ হারাম দ্বারা পুষ্ট হয়, জান্নাত তার জন্য হারাম।” (তিরমিজি)
গোপন কারণ ৩: যাকাত ও দান-সদকা উপেক্ষা
-
ইসলামে যাকাত ফরজ, কিন্তু অনেকেই তা এড়িয়ে যান।
-
যাকাত না দিলে সম্পদ অশুদ্ধ হয়ে যায়, আর বরকত কমে যায়।
-
দান-সদকা দিলে বিপদ দূর হয়, রিজিক বৃদ্ধি পায় এবং গুনাহ মাফ হয়।
গোপন কারণ ৪: আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা
-
হাদীসে এসেছে: “যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, তার রিজিক সংকুচিত হয়।”
-
আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ রাখা, খোঁজ-খবর নেওয়া এবং সাহায্য করা রিজিক বৃদ্ধি করে।
গোপন কারণ ৫: অন্যের হক নষ্ট করা
-
কারো প্রাপ্য বেতন আটকে রাখা, অন্যের সম্পদ দখল করা বা প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ নেওয়া রিজিক থেকে বরকত কমিয়ে দেয়।
-
ন্যায়সঙ্গত উপায়ে উপার্জনই একমাত্র শান্তি ও বরকতের পথ।
কুরআন ও হাদীসে রিজিক সম্পর্কিত আলোচনা
রিজিক সম্পর্কে অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হলো:
-
কুরআন: “আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সীমাহীন রিজিক দেন, আবার যাকে ইচ্ছা সংকুচিত করে দেন।” (সূরা রা’দ: ২৬)
-
হাদীস: রাসূল ﷺ বলেছেন— “যে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে, আল্লাহ তার রিজিক সহজ করে দেন।” (মুসনাদে আহমাদ)
এসব থেকে প্রমাণিত হয় যে, রিজিক শুধু পরিশ্রমের ওপর নির্ভর করে না, বরং আল্লাহর রহমতের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
রিজিক বৃদ্ধি করার বাস্তব উপায়
রিজিক শুধু চেষ্টা বা যোগ্যতার উপর নির্ভর করে না, বরং আল্লাহর রহমতের সাথে সম্পর্কিত। তবে ইসলাম আমাদের কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যা অনুসরণ করলে রিজিক বৃদ্ধি পায় এবং জীবনে বরকত আসে।
হালাল আয়ের উপর জোর দেওয়া
-
হালাল উপায়ে রিজিক অর্জন করা ইসলামি জীবনের অন্যতম প্রধান শর্ত।
-
হারাম আয় থেকে দূরে থাকলে আল্লাহর রহমত নেমে আসে।
-
ছোট আয় হলেও যদি তা হালাল হয়, তাতে শান্তি ও বরকত থাকবে।
নিয়মিত যাকাত ও সদকা প্রদান
-
যাকাত ফরজ ইবাদত। এটি শুধু সম্পদকে পরিশুদ্ধই করে না, বরং বরকতও আনে।
-
সদকা দিলে রিজিক বৃদ্ধি পায় এবং বিপদ দূর হয়।
-
হাদীসে এসেছে: “সদকা রিজিক বৃদ্ধি করে এবং বিপদ দূর করে।”
দোয়া ও ইস্তেগফার বেশি বেশি করা
-
গুনাহ মানুষকে রিজিক থেকে বঞ্চিত করে।
-
আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে বরকত আসে।
-
কুরআনে বলা হয়েছে:
“তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চাও, তিনি আকাশ থেকে বরকতময় বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান দ্বারা শক্তিশালী করবেন।” (সূরা নূহ: ১০-১২)
সম্পর্ক রক্ষা ও সদাচরণ
-
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে আল্লাহ রিজিক বৃদ্ধি করেন।
-
অন্যের হক আদায় করা, সদাচরণ করা এবং মানুষের উপকার করা রিজিক বাড়ায়।
পরিশ্রম ও পরিকল্পনা
-
ইসলাম পরিশ্রমকে উৎসাহিত করে।
-
পরিকল্পনা করে কাজ করলে আয় সঠিকভাবে ব্যয় হয় এবং অপচয় কমে।
-
পরিশ্রমের সাথে দোয়া করলে আল্লাহ তাতে বরকত দেন।
আধুনিক জীবনে রিজিক সংকটের সামাজিক কারণ
বর্তমান সমাজে অনেকেই লক্ষ্য করেন, আয় অনেক হলেও তা টিকছে না। এর পেছনে সামাজিক কিছু কারণ রয়েছে:
-
অতিরিক্ত ভোগবাদ: অপ্রয়োজনীয় খরচ এবং বিলাসিতা রিজিকের বরকত কমিয়ে দেয়।
-
ঋণের ফাঁদ: সহজে ঋণ নেওয়া এবং সুদের বোঝা জীবনকে জটিল করে তোলে।
-
পরিবারে অশান্তি: পারিবারিক ঝগড়া বা অবিশ্বাসও রিজিক থেকে বরকত সরিয়ে দেয়।
-
অসততা ও প্রতারণা: ব্যবসা বা চাকরিতে অসততা দীর্ঘমেয়াদে বরকত কমিয়ে দেয়।
📌 তাই, সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করে এবং দায়িত্বশীল জীবনযাপন করাও রিজিক বৃদ্ধির অন্যতম উপায়।
মানসিকতা ও রিজিক: ইতিবাচক চিন্তার শক্তি
-
ইতিবাচক চিন্তা মানুষকে সঠিক পথে চালিত করে।
-
হতাশা ও অভিযোগ রিজিকের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
-
আল্লাহর প্রতি ভরসা (তাওয়াক্কুল) করলে মন শান্ত হয় এবং রিজিকের পথ খুলে যায়।
👉 রাসূল ﷺ বলেছেন:
“যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ভরসা রাখতে, তবে তিনি তোমাদের এমনভাবে রিজিক দিতেন যেমন পাখিকে দেন— সকালবেলায় ক্ষুধার্ত বের হয় আর সন্ধ্যায় পেটভরে ফিরে আসে।” (তিরমিজি)
সাধারণ ভুল ধারণা ও এর সমাধান
অনেকে মনে করেন, রিজিক শুধুই ভাগ্যের খেলা। আবার কেউ কেউ মনে করেন বেশি আয় করলেই রিজিক বৃদ্ধি পায়। এগুলো ভুল ধারণা।
-
ভুল ধারণা ১: শুধু পরিশ্রমেই রিজিক নির্ধারণ হয়।
👉 সত্য হলো, পরিশ্রমের সাথে সাথে আল্লাহর রহমত প্রয়োজন। -
ভুল ধারণা ২: বেশি অর্থ মানেই বেশি রিজিক।
👉 সত্য হলো, রিজিকের মধ্যে শান্তি, স্বাস্থ্য, বরকতও অন্তর্ভুক্ত। -
ভুল ধারণা ৩: যাকাত না দিলেও সম্পদ বাড়ে।
👉 সত্য হলো, যাকাত ছাড়া সম্পদ অশুদ্ধ হয় এবং বরকত হারায়।

Post a Comment